সন্তান জন্মদান পরবর্তী মায়ের বিষন্নতা
প্রথমবার হোক বা চতুর্থবার, সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি একজন মায়ের জন্য একই সাথে আনন্দের এবং উত্তেজনার। বিশেষ করে বাচ্চার জন্মের পরের কিছুদিন মায়ের আচরণে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। অতিরিক্ত আবেগ, কান্নাকাটি, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, এ ধরণের লক্ষণ খুবই সাধারণ।
বাচ্চা প্রসবের পর শতকরা ৭৫-৮০ ভাগ মায়েরাই বিভিন্ন ধরনের বিষন্নতায় ভুগে থাকেন; একে মাতৃত্বকালীন বিষন্নতা বা প্রসবোত্তর বিষন্নতা বলা হয়। নতুন মায়েদের ওপর এই বিষন্নতা বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। কারো মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কারো হয়তো কোন কারণ ছাড়াই কান্না চলে আসে। বুকে চাপ বোধ হয়, সর্বক্ষণ উদ্বেগ আর অস্থিরতাবোধ হয়। ক্লান্ত লাগে অথচ ঘুম আসে না। এ সবই মাতৃত্বকালীন বিষন্নতার লক্ষণ।
মাতৃত্বকালীন বিষন্নতার কারণঃ
গর্ভধারণ এবং প্রসবের সময় একজন নতুন মায়ের শরীরে যে বিশাল হরমোনজনিত পরিবর্তন আসে তারই ফলাফল এই বিষন্নতা। গর্ভধারণের সময় মায়ের শরীরে এস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ অনেক গুণে বেড়ে যায়; আবার প্রসবের পরপরই হঠাৎ করেই দ্রুত তা হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে মেজাজ খারাপ, বিষন্নভাব, উদ্বেগ ও অস্থিরতা জাতীয় লক্ষণ নতুন মায়েদের মাঝে দেখা যায়। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই কারণ পুরো ব্যাপারটাই সাময়িক এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। প্রসবের এক সপ্তাহের মাঝেই যখন মায়ের শরীর দুধ তৈরি করা শুরু করে তখনই এসব হরমোন তাদের স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে যায়।
এ সময় মায়েদের খাবারের রুচিরও পরিবর্তন দেখা যায়। তবে এ সময়ে শারীরিক পরিবর্তনের থেকে মানসিক পরিবর্তনগুলোই মায়েদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। বাচ্চার সাথে সময় কাটানো শুরু করার পর থেকেই মায়েরা হঠাৎ মা হওয়ার দায়িত্বগুলো উপলদ্ধি করতে শুরু করে। বুকের দুধ পান করানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে, আবার বাচ্চার যত্ন কীভাবে নিতে হবে এ ব্যাপারে তারা অনিশ্চিতবোধ অনুভব করতে পারে। বাচ্চার কারণে মায়েরা অনেক ক্লান্ত বোধ করলেও রাতের পর্যাপ্ত ঘুমের সুযোগ পায় না। এই কারণে দিনের বেলা পরিবার-পরিজনরা দেখা করতে এলে পুরো ব্যাপারটার ধকল তাকে আরো ক্লান্ত করে দেয়। বাচ্চা লালন পালনের দায়িত্বের ভার উপলদ্ধি করে মায়েরা নিজেদেরকে বন্দী মনে করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সারাক্ষণ তারা উদ্বিগ্ন থাকে অথবা তাদের মেজাজ খারাপ থাকতে পারে।
এই ক্লান্তি ও বিষন্নভাব যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় তবে একে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলা হয়। এ সমস্যা বাচ্চার জন্মের পর থেকে শুরু করে জন্মের এক বছরের মাঝে যেকোনো সময়েই দেখা দিতে পারে।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন যেকোনো নারীর ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে যাদের আগেও বাচ্চা জন্মের সময় এই সমস্যা হয়েছে বা বংশগতভাবে ডিপ্রেশনজনিত সমস্যা আছে তাদের এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরিবার থেকে সহযোগিতা ও সাহচর্যের অভাব এবং প্রসবকালীন জটিলতা ও অসুস্থতার কারণেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মাতৃত্বকালীন বিষন্নতা কতোদিন স্থায়ী হয়?
প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই এর স্থায়িত্বকাল ভিন্ন ভিন্ন, তবে এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই কারণ এটা সাময়িক এবং কোনো অসুস্থতা নয়। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, আশেপাশের পরিবার ও পরিজনের সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় এই সমস্যা সাধারণত কিছুদিনের মাঝেই কেটে যায়।
বিষন্নতায় আক্রান্ত মায়েদের কীভাবে সাহায্য করা যায়?
মাতৃত্বকালীন বিষন্নতা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হলেও সচরাচর মানুষ এটা টের পায় না। নতুন মায়ের কাছের লোক এবং পরিবারের সদস্যদের মাতৃত্বকালীন বিষন্নতার লক্ষণ টের পেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা খুব জরুরি। পরিবারের সহযোগিতা বা ক্ষেত্রবিশেষে ডাক্তারের পরামর্শে সহজেই এ সমস্যার উপশম সম্ভব। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিষন্নতা স্থায়ী হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
নতুন মায়েদের নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে এবং তারা যে নতুন নতুন জিনিস শিখছে এ ব্যাপারটা তাদের মনে করিয়ে আশ্বাস দিয়ে যেতে হবে। আরও যা যা করা যায় –
- মায়েরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলে তাদের কাঁদতে দিন, তাদের আশ্বাস দিন যে এটা কেবলই মাতৃত্বকালীন বিষন্নতার কারণে হচ্ছে এবং শীঘ্রই ভাল হয়ে যাবে।
- তার প্রতি সংবেদনশীল এবং শ্রদ্ধাশীল হন। ধৈর্য্য ধরার চেষ্টা করুন এবং যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে তাকে জিজ্ঞাসা করুন।।
- তাকে বিশ্রাম নিতে উৎসাহ দিন।
- এরকম সময়ে স্বামীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাকে জানান, যা-ই হোক আপনি সবসময় তার পাশেই আছেন। তাকে তার নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য সময় ও সুযোগ করে দিন।
- এ সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার এবং মানবিক সাহচর্য খুবই জরুরি। ক্লান্তি, ঘুমের অভাব ও উদ্বেগের মাঝে বেশিক্ষণ থাকলে বিষন্নতা আরো বাড়বে।
- বিষন্নতার সময়ে মায়েদের উচিত তার পরিবারের মানুষদের থেকে শিশু পালন এবং ঘর সংসার সামলানোর জন্য সাহায্য নেওয়া। রান্নাবান্না বা অন্যান্য দায়িত্ব অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে মা যেন বাচ্চার সাথে সময় দিতে পারে বা বিশ্রাম নিতে পারে সে সুযোগ করে দেওয়া। পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং অন্যান্য নতুন মায়েদের সাথে কথা বলাও বেশ সাহায্য করে এসব ক্ষেত্রে।